
চিকিৎসক সংকটে ভুগছে শরীয়তপুর জেলা সদর হাসপাতাল সহ প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং মা ও শিশু চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো। সেই সুযোগে কতিপয় ভূয়া চিকিৎসক জেলার বিভিন্ন হাট বাজার ও গ্রাম মহল্লায় প্রবেশ করে অপচিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে। এতে প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান বিষয়টি দেখবেন বলেও কোন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। পদক্ষেপ গ্রহন করছেন জেলা ও উপজেলা প্রশাসন।
শরীয়তপুরের বিভিন্ন গ্রাম-মহল্লা ও হাট-বাজার ঘুরে দেখা যায়, নাম সর্বস্ব কতিপয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়মিত বা অনিয়মিত চিকিৎসা সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। তাদের কোন বৈধ সনদ বা ডাক্তার লেখার বৈধ অধিকার নাই। তবুও তারা ডাক্তার। আর এই ধরনের ডাক্তারদের প্রতারণার সুযোগ করে দিচ্ছেন বাজার মহল্লার কোন ওষুধ ব্যবসায়ী বা ফার্মেসীর মালিক। কখনও এই ধরনের ডাক্তারগণ বেছে নেন গ্রাম-মহল্লার কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির বাড়ি। পোস্টার, ফেস্টুন ও লিফলেট ছড়িয়ে দেয় সর্বত্র। মাইকিং করে মানুষকে জানান দেয় এই ডাক্তার সর্বরোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এই নাম সর্বস্ব ডাক্তারের প্রতারণায় সহযোগিতা করছে তাদের লালিত দালাল। এলাকার সহজ সরল সাধারণ মানুষকে তারা জিম্মি করে ঠকিয়ে যাচ্ছেন সর্বক্ষণ। রোগীদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে বা সরকারি হাসপাতালে যেতে দিচ্ছেন না এই দালাল চক্র। বিভিন্ন বে-সরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতলগুলো নিয়মিত মাইকিং করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। সেই সকল চিকিৎসক কতটা বিশেষজ্ঞ তা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন থেকে যায়।
শরীয়তপুর পৌরসভার আংগারিয়া বাজারে ছোট মনির নামে একজন তৃতীয় শ্রেণীর ফার্মাসিস্ট রয়েছেন। তিনি ফাতেমা মেডিকেল হল নামে একটি ফার্মেসী দিয়ে দেশী-বিদেশী ওষুধ বিক্রির নাম করে সিরিয়াল দিয়ে রোগী দেখেন। প্রেসক্রিপশন করেন। তিনি প্যাথলজি পরীক্ষা নীরিক্ষা লিখে বিভিন্ন বে-সরকারি ডায়াগণস্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে দেন। তিনি আংগারিয়া ও আশপাশ এলাকার রোগীদের কাছে ছোট মনির ডাক্তার নামে পরিচিত। ছোট মনির হওয়ার কারণ হিসেবে জানা গেছে আংগারিয়া বাজারে এমবিবিএস ডা. মনির নামে অপর একজন ডাক্তার রয়েছেন। এ বিষয়ে ডা. ছোট মনির জানায়, চিকিৎসা বিদ্যা সম্পর্কে তার কোন সনদ নাই কিন্তু অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি রোমান ডাক্তারের সাথে ৬ বছর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিল। রোমান ডাক্তারের সম্পর্কে খোজ নিয়ে জানা যায় সে আংগারিয়া বাজারের একজন প্রয়াত পল্লী চিকিৎসক ছিলেন।
আর.এম.পি. কোর্চ করে ডাক্তার পরিচয়ে (ফিস) ভিজিট নিয়ে সদর উপজেলার গঙ্গানগর বাজারের বাতেন ডাক্তারের ফার্মেসীতে রোগী দেখেন আরও একজন ডাক্তার। তার বিলিকৃত লিফলেট থেকে জানা যায় তিনি সর্বরোগ বিশেষজ্ঞ। এই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে আলাপ কালে জানায় তিনি মাদারীপুর জেলার শিবচর থেকে আসেন। প্রতি বৃহস্পতিবার সদর উপজেলার গঙ্গানগর বাজারের বাতেন ডাক্তারের ফার্মেসীতে সকাল ৯টা থেকে যতক্ষণ রোগী থাকে ততক্ষণ রোগী দেখেন। মঙ্গলবার ও বুধবার মাইকিং করে লিফলেট বিতরণ করা হয়। এই ডাক্তার সৌদি আরবের একটি ক্লিনিকে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সহযোগী ছিলেন। সেখান থেকে কিছুটা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। দেশে ফিরে আর.এম.পি. কোর্স করে ডাক্তার হয়েছেন। এখন সে দাপটের সাথে চিকিৎসার নামে প্রতারণা করে যাচ্ছেন। ফার্মেসী মালিক আ. বাতেন বলেন, ওষুধ কোম্পানীর একজন রিপ্রেজেনটিভ এই ডাক্তারকে আমার কাছে এনে দেয়। সেই থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার সকাল থেকে আমার ফার্মেসীতে সে বসে চিকিৎসা প্রদান করে। এতে আমার হয়তো ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার ওষুধ বেশী বিক্রি হয়। ডাক্তার রোগীর কাছ থেকে ফিস নেয়। এর কাছ থেকে চিকিৎসা গ্রহন করে রোগী ভালো হয়। এখন পর্যন্ত রোগীর কোন অভিযোগ পাইনি।
শরীয়তপুর পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডে অফিসার ক্লাবের নিকট খান বাড়িতে পলিপাচ পাইলস কেয়ার “সিটি সেন্টার” নামে চিকিৎসা কেন্দ্র খুলে দিব্বি চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন ডা. সুজন মজুমদার। তিনি বিশিষ্ট পাইলস পলিপাচে অভিজ্ঞ (কলকাতা) আর.এম.পি. (ঢাকা) থেকে ডিগ্রীধারী। প্রতি মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন।
এমনি ভাবে প্রতিটি বাজার মহল্লায় চিকিৎসার নামে এই প্রতারণা চলছে। এই প্রতারণা দেখার যেন কেউ নাই।
এখন জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়েছে। গত ৩ অক্টোবর বৃহস্পতিবার গোসাইরহাট উপজেলার দাসের জঙ্গল বাজারের জননী মেডিকেল হলে অভিযান চালিয়ে এক ভূয়া ডাক্তারকে গ্রেফতার করেছেন উপজেলা প্রশাসন। ভূয়া ডাক্তার কৃষ্ণ কর্মকার উপজেলার মিত্রসেনপট্টি গ্রামের শ্যাম কর্মকারের ছেলে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে ধৃত ভূয়া ডাক্তারকে ১ লাখ টাকা জরিমানা ও আদায় করেন। ইতোপূর্বে শরীয়তপুরের প্রাণকেন্দ্র চৌরঙ্গী এলাকার সিটি আধুনিক হাসপাতাল থেকে এক ভূয়া ডাক্তার গ্রেফতার হয়। এভাবেই চলছে শরীয়তপুরে প্রতারণা চিকিৎসা বাণিজ্য।
জেলা সিভিল সার্জণ অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শরীয়তপুর সদর হাসপাতাল বাদে জেলার ৬টি উপজেলায় ১২৬ জন চিকিৎসকের মঞ্জুরীকৃত পদ রয়েছে। তাদের মধ্য থেকে বিভিন্ন উপজেলায় পদায়ণ রয়েছেন ৫৬ জন চিকিৎসক। ৬টি উপজেলায় চিকিৎসকের শূণ্য পদ রয়েছে ৭০টি। পদায়নকৃত ৫৬ জনের মধ্য থেকে প্রশিক্ষনে রয়েছেন ২ জন, জেলার বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে বেতন-ভাতাদি গ্রহন করেন কিন্তু কর্মরত রয়েছেন ভিন্ন জেলায় এমন রয়েছেন ২৬ জন চিকিৎসক। ২০১১ সাল থেকে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কর্তৃপক্ষের কাছে খোঁজ খবর নাই এমন চিকিৎসকের তালিকায় রয়েছে ৮ জন চিকিৎসকের নাম। তাহলে জেলার ৬টি উপজেলায় প্রায় ১২ লক্ষ মানুষের জন্য চিকিৎসক বরাদ্দ রয়েছেন ২০ জন। সেই সুযোগেই ভূয়া চিকিৎসকের সয়লাব ঘটেছে।
গোসাইরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায় ১৩ চিকিৎসকের বিপরীতে টিএইচও ও আরএমও কর্মরত রয়েছে। সেখানে কোন কনসালটেন্ট, গাইনী ও মেডিকেল অফিসারের সকল পদ শূণ্য। প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একই চিত্র।
শরীয়তপুর সদর হাসপাতাল সূত্র জানায়, হাসপাতালে ৫০টি চিকিৎসকের পদ রয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি পদে চিকিৎসক পদায়ণ রয়েছে। অপর ৩২টি পদের মধ্যে সিনিয়র কনসালটেন্ট, জুনিয়র কনসালটেন্ট, গাইনী ও মেডিকেল অফিসারের পদ শূণ্য রয়েছে।
এ বিষয়ে জেলার সিভিল সার্জন ডা. খলিলুর রহমান বলেন, আর.এম.পি. অথবা ফার্মাসিস্ট কোর্স করে ডাক্তার লেখার কোন সুযোগ নাই। তারা শুধু বিনা প্রেসক্রিসশনে মানুষকে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে পারবে। যেখানে এ ধরনের অনিয়ম রয়েছে তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। জেলায় যে চিকিৎসক সংকট রয়েছে তা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে শরীয়তপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন অপু বলেন, জেলায় যতজন চিকিৎসক পদায়ণ রয়েছে ততজন চিকিৎসককে নিজ নিজ কর্মস্থলে উপস্থিত দেখতে চাই। প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করছেন। চিকিৎসার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোন আপোষ নাই। আর যে সকল ভূয়া চিকিৎসকগণ সুযোগ নিচ্ছে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।