
এই প্রথম আইন আদালতের পদ্ধতিগত ত্রুটি বা ভুলের সমালোচনা না করে বাহবা দেবার জন্য লিখতে বসেছি। ‘সাপে বরের’ এরচেয়ে ভালো নজির হতে পারে না। মাত্র কয়েক ঘন্টায় ‘সঠিক-ভুল-সঠিক’ চক্রে শেষমেশ ভুলের জয়! এরপর আবার নাটকীয়তা! এ যেন কোন সুনিপুণ নাট্যকারের রহস্যময় চিত্রনাট্য।
করোনার আঘাতে সারাদেশের সব আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ। অন্যান্য জেলার মত শরীয়তপুর বারের বিজ্ঞ আইনজীবীগণও বাসায় অলস সময় পার করছেন। এর মাঝেও যেহেতু জি.আর.ও সেকশন খোলা রাখতে হয়, তাই দু’একজন আইনজীবীকেও থাকতে হয়। শুধুমাত্র গ্রেফতারকৃত আসামীদের বেলায় জামিন চাওয়ার সুযোগ আছে। সাধারণত ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫১ কিংবা পুলিশ আইনের ৩৪ ধারার মতো লঘু অপরাধে আটক আসামীদের জামিন আইনজীবীর সশরীরে শুনানী ছাড়াই মঞ্জুর হয়। সরাসরি শুনানি ছাড়া অন্য গুরুতর মামলার জামিন না হওয়া স্বাভাবিক এবং সঠিকও।
সেই ধারাবাহিকতায় গত ৩০ এপ্রিল একটা নালিশী মামলার (যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ ধারা) আসামীকে পুলিশ গ্রেফতার করে বিজ্ঞ আদালতে উপস্থাপন করলে বিজ্ঞ আদালত স্বাভাবিকভাবেই ঈ/ড মূলে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। কিন্তু কান্ড ঘটলো আসামীকে নিয়ে পুলিশ কারা কর্তৃপক্ষের কাছে বুঝিয়ে দিতে গেলে। পুলিশ বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশের কপিসহ সকল কাগজপত্র নিয়ে গেলেও জেলার আসামীকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে! ঠিকই শুনলেন। জেলার এই আসামীকে রাখবেন না। কিন্তু কেন? ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ অমান্য করার তো প্রশ্নেই উঠে না। আইনগত ভাবেও তো তিনি আসামী রাখতে বাধ্য। কি ঘটেছিলো সেখানে?
ঘটনা হচ্ছে আসামীকে জেলে ঢুকানোর সময় জেলার আসামীকে কিছু প্রশ্ন করেন। আর সেখানেই বাধেঁ বিপত্তি। প্রশ্নোত্তরের এক পর্যায়ে জেলার জানতে পারেন, আসামী করোনার হটস্পট খ্যাত নারায়নগঞ্জ থেকে এসেছে! তাছাড়া তার শরীরের তাপমাত্রাও ছিলো আশংকাজনক। ব্যাস। এতেই জেলার বাধ সেধেছেন! তিনি কোনভাবেই এই আসামীকে কারাগারে ঢুকতে দেবেন না। তাহলে পুলিশ আসামীকে নিয়ে যাবে কোথায়? আদেশ হয়ে গেছে, এখন তো থানায়ও রাখতে পারবে না। এমন পরিস্থিতিতে জেলার বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেন শরীয়তপুরে সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে। পুরো বিষয়টি খুলে বলেন। সব শুনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও তাকে কারাগারে না রাখার জন্য মতামত দেন। এরপর জেলার বিষয়টি বিচক্ষণতার সাথে আদেশ দানকারী বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটকে অবগত করেন। বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট সব শুনে স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়ে নিশ্চিত হন। একজন আসামীর জন্য শতশত কারাবন্দীর জীবন ঝুঁকিতে পরতে পারে না। এমন পরিস্থিতিতে দফায় দফায় বিজ্ঞ সিজেএম, জেলার এবং আদেশ দানকারী ম্যাজিস্ট্রেটের মধ্যে তৃপক্ষীয় কথোপকথন চলতে থাকে। শেষমেষ, বিজ্ঞ আইনজীবী ড. আমিনুল ইসলাম নতুন করে জামিন আবেদন করলে বিজ্ঞ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জনাব তানভীর আহমেদ দেশের করোনা পরিস্থিতি এবং আসামীর বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন থাকার যৌক্তিকতা আমলে নিয়ে আসামীর পরবর্তী ধার্য তারিখ পর্যন্ত অস্থায়ী জামিন মঞ্জুর করেন। আসামী এমন অনাকাঙ্খিত সান্ধ্যকালীন জামিন পেয়ে মনের আনন্দে বাড়ি ফিরে।
পরের দিন আসামীর বাড়িতে পুলিশসহ জেলা প্রশাসনের লোক হাজির হয়ে তাকে বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইনের নির্দেশ দেন। এর সাথে তার নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য আইইডিসিআর’এ পাঠিয়ে দেয়া হয়। নমুনা সংগ্রহের দুই দিনের মাথায় ঐ ব্যক্তির রিপোর্টের ফলাফল আসে। ফলাফল পজেটিভ! এ পর্যন্ত পড়তে গিয়ে পাঠক নিশ্চয়ই কিছু পদ্ধতিগত ভুল ধরতে পেরেছেন। কিন্তু দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সেগুলো স্কিপ করে যাওয়াই ন্যায়সঙ্গত। কেননা, দ্বায়িত্ব সচেতন জেলার যদি তার কর্মদক্ষতা আর বিচক্ষণতা না দেখাতেন পুরো কারাগারের শতশত কারাবন্দী নিশ্চিতভাবেই জীবন সংশয়ে পরতো। শরীয়তপুর জেলা কারাগারের জেলার হাসনা জাহান বিথি মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে জানান, স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি আন্দাজ করে আমি বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব মোঃ মাহাবুর রহমান শেখ’কে অবহিত করি। তার পরামর্শ ও নির্দেশনায় আমি বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট জনাব তানভীর রহমান’কে বিষয়টি জানালে তিনি স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে দ্রুত যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ায় বড় ধরনের দূর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় শত শত কারাবন্দী।
ঘটনা এখানেই শেষ না। করোনা আক্রান্ত নিশ্চিত হওয়ার পর জেলা স্বাস্থ্য প্রশাসন ছুটে যায় ঐ রোগীর বাড়িতে। স্বাস্থ্য প্রশাসনের নিয়মিত ফলোআপ এবং আক্রান্ত রোগীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ পূর্বক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তারা রোগীর খোঁজে যান। কিন্তু বিধিবাম! রোগী তো চম্পট! রোগীর বাড়ির লোকজন তাদের জানায়, রোগী গত ৩-৪ দিন যাবত হারিয়ে গেছে! তাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। সে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কেউ জানে না! চিন্তা করতে পারছেন? একজন করোনা আক্রান্ত রোগী পুরো জেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার খবর কেউ জানে না। না জানি তার মাধ্যমে কত শত লোক আক্রান্ত হচ্ছে! শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এখনো তাকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। প্রশাসন সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাকে খুঁজে বের করতে। কারা কর্তৃপক্ষের বিচক্ষণতায় কারাবন্দীরা নিরাপদ থাকলো। কিন্তু জেলা স্বাস্থ্য প্রশাসন যদি দ্রুত আক্রান্ত ব্যক্তিকে খুজেঁ না পায়, তবে স্বাস্থ ঝুঁকিতে থাকছে লক্ষাধিক মানুষ।
-এডভোকেট শহিদুল ইসলাম সজীব,
শরীয়তপুর জজ কোর্ট,
mdshahidulislam0038@gmail.com