
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সোমবার ১টি ড্রেজার পদ্মার ভাঙ্গন এলাকায় পৌছালেও গত ২ দিনেও ড্রেজার দ্বারা কার্যক্রম শুরু করতে পারেননি।
২ দিনেও ড্রেজার দ্বারা কার্যক্রম শুরু না করার প্রশ্নের জবাবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী একেএম ওয়াহিদ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, এখন পানির স্রোত বেশী স্রোত নিয়ন্ত্রনে আসলেই নদীর ক্যানেল নির্ধারন করে কাজ শুরু করা হবে।
জানুয়ারীতে প্রকল্প পাশ হইছে। মডেল স্টাটি রিভার রিচার্চ ইনস্টিটিউট গত জুন থেকে কাজ শুরু করেছে। রিভার রিচার্চ ইনস্টিটিউট এখন কনফার্ম ছাড়াই কাজ শুরু করতে যাচ্ছি। বড় প্রকল্প ও ঠিকাদার নিয়োগ করতে সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। বাংলাদেশ নৌবাহিনীরর অধিনে খুলানা ডগইয়ার কাজ করতে যাচ্ছে। ড্রেজার একটি আসছে আরো ২টি ড্রেজার আসবে।
মঙ্গলবার সকাল ৯টায় নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়ের সচিব মোঃ আব্দুস সামাদ ও বিআইডাব্লিটিএর চেয়ারম্যান এম মোজাম্মেল হক ভাঙ্গন এলাকায় পরিদর্শনে আসেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী একেএম ওয়াহিদ উদ্দিন চৌধুরী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াসমিন, নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ মুনির আহম্মেদ খান, ভেদরগঞ্জ উপজেলা পিআইও কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা ও কেদারপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ইমাম হোসেন দেওয়ান প্রমূখ।
নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়ের সচিব মোঃ আব্দুস সামাদ ও বিআইডাব্লিটিএর চেয়ারম্যান এম মোজাম্মেল হক ভাঙ্গন এলাকায়
নড়িয়া উপজেলায় পদ্মা নদীর ভাঙ্গন এলাকা পরিদর্শনে নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়ের সচিব মোঃ আব্দুস সামাদ ও বিআইডাব্লিটিএর চেয়ারম্যান এম মোজাম্মেল হক ভাঙ্গন এলাকায় পরিদর্শনে আসেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী একেএম ওয়াহিদ উদ্দিন চৌধুরী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াসমিন,।
পরিদর্শনে এসে বলেন, ক্যাবিনেটের এক সভায় প্রধান মন্ত্রীর নির্দেশে চিরস্থায়ী ভাঙ্গন রক্ষা ও ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহন কার হয়েছে। এই প্রকল্পটি একটি বড় ধরনের প্রকল্প। কিছুদিন পূর্বে ভোলাতেও এর মোকাবেলা করা হয়েছে। বর্তমানে বিআই ডাব্লিউটিএ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় ও নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয় যৌথ ভাবে কাজ করতে যাচ্ছে। বর্তমানে জিও ব্যাগ দিয়ে ভাঙ্গন রক্ষায় কাজ চলছে। ভারতে এবং তিব্বতে বন্যা হয়েছে সেই কারনে পানির স্রোত কমছে না। গত বছর ও তার আগের বছর এসময় এখানে এরকম স্রোত ছিলো না। ধৈর্য্য ধারন করেত হবে ১১’শ কোটি টাকার কাজ হতে যাচ্ছে নভেম্বর ব্লকের কাজ শুরু ও জিও ব্যাগের পরিমান আরো বাড়ানো হবে।
এদিকে ভাঙ্গনের শিকার লোকের আহাজারী। ‘এহন যদি ভাঙন না থামায়, কাজ যদি না ধরে, তাইলে নড়িয়ার কেদারপুর ইউনিয়ন ও পৌরসভা নদীতে চৈলা যাইবো। চৌদ্দ আনি গেছেগা। দুই আনি আছে। কেদারপুর ইউনিয়নের ৯ডা ওয়াডের জায়গা নদীতে গেছেইগা। আার ৩ডা ওয়ার্ড আছে।
কেদারপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা মজিবুর রহমান চোকদার এসব কথা বলেন। ড্রেজার আরো একবছর আগে আনা দরকার ছিলো। ড্রেজার আনছে ড্রেজার না চালাইতে পারলে ড্রেজার লইয়া যাক। দরকার নাই ড্রেজার। ড্রেজার এহানে দেহাইয়া আমাগো আরো ক্ষতি করতাছে।
স্থানীয় ইউনুছ কোটারী বলেন, ৪০ শতাংশ জমিসহ বড়িতে ৩টি ঘর ছিলো বিভিন্ন প্রজাতীর গাছ ছিলো। সবই সপ্তাখানেক আগে পদ্ময় বিলিন হইয়া গেছে। শুনলাম ড্রেজার আসছে। আবার শুনলাম পানি না কমলে ড্রেজার দিয়া কোন কাজ করতে পারবে না।
নূর হোসেন দেওয়ান (৭০) জানায়, তাদের চারশত বছরের জমিদারি ছিল। নড়িয়া উপজেলার সাহেবের চর, চর জুজিরা, চর নড়িয়া, বশাক চর ও পাঁচগাঁও এলাকায় তাদের তিনশত বিঘা (একশত একর) জমি ছিল। তাদের পূর্ব পুরুষ কেদার পুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিল। তারাই এ ইউনিয়ন সহ আশপাশের ইউনিয়নে নেতৃত্ব প্রদান করত। তার বাড়িতে একটি দ্বিতল বিশিষ্ট দালান, ৪টি পাঁকা টিনশেট ঘর ও একটি কারুকার্য সম্পন্ন কাঠের ঘর ছিল। এ সকল দালান-ঘর পদ্মা গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে।
পরবর্তীতে মূলফৎগঞ্জ বাজারে অবস্থিত দেওয়ান ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে ৪তলা ভবনে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ওঠেন ওই পরিবার। সেই ক্লিনিক পদ্মার আগ্রাসী ছোবল ছিনিয়ে নেয়ার পর হাসপাতাল সংলগ্ন মসজিদে ওঠেন নুর হোসেন দেওয়ান।
স্ত্রী-সন্তানরা আশ্রয় নেয় উপজেলার ভোজেশ্বর এলাকায় এক আত্মিয়ের বাড়িতে। ভাই-ভাতিাজা ও তাদের পরিবার সুবিধামত স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। কে কোথায় কিভাকে আছে তা নূর হোসেন দেওয়ানের জানানাই। মসজিদ নদী গর্ভে চলে যাওয়ার পর নূর হোসেন দেওয়ান নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পুরাতন ভবনের তৃতীয় তলায় অবস্থান করছেন। কেউ খাবার পাঠালে খায় নতুবা অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটান সে। অথচ নূর হোসেন দেওয়ান ১৯৮০ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারকে আয়কর প্রদান করে আসছে। এ পর্যন্ত তিনি ৪ কোটির বেশি টাকা আয়কর প্রদান করেছেন।
দেওয়ান পরিবারের কাঠে কারুকার্য খোচিত ঘর নদী ভাঙ্গনের ঝুঁকিতে আসলে গ্রাহক ঘরটির মূল্য ৪০ লাখ টাকা নির্ধারণ করে। নূর হোসেন দেওয়ান ঘর বিক্রি করেনি। সেই ঘরও নদী গর্ভে চলে গেছে। যখন বাংলাদেশে ১৭ জেলা ছিল তখনকার সময় কোন জেলা প্রশাসক বা পুলিশ সুপার শরীয়তপুরে অবস্থান করলে ওই ঘরে থাকতেন। সাধারণ মানুষ সেই ঘরে প্রবেশ করলে দেওয়ান পরিবারের অনুমতির প্রার্থণা করত। বর্তমান বাজাম মূল্যে সেই ঘরের নির্মাণ ব্যায় হবে কোটি টাকার উপরে।
চিকিৎসা সেবায় দেওয়ান ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার জাতী সংঘের সনদ অর্জণ করেছিল। বাংলাদেশ সরকারও দেওয়ান ক্লিনিকের চিকিৎসা সেবায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করে সনদ দেয়। গত ৫ সেপ্টেম্বর চোখের পলকে দেওয়ান ক্লিনিক এন্ড ডায়াগণস্টিক সেন্টারটি পদ্মা গর্ভে বিলিন হয়ে যায়। ১৯৫২ সালে মুলফৎগঞ্জ হাসপাতাল নির্মিত হয়। তৎকালিন পূর্ব বাংলার গভর্ণর মনায়েম খান এ হাসপাতালের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। তখন তিনি দেওয়ান পরিবারের কাঠের কারুকার্য খোচিত ঘরে অবস্থান ও মধ্যাহ্নভোজ করে। হাসপাতালের জন্য আমরা ১৮ বিঘা (৬ একর) জমি দান করি। তারপরেও ওই জমি আমাদের নামেই ছিল। গত বি.আর.এস. রেকর্ডে হাসপাতালের জমি সরকারের নামে রেকর্ড করে দেই। এ হাসপাতালের বর্তমান নাম নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। হাসপাতালে ৬ একর জমির বর্তমান বাজার মূল্য হবে ১০০ কোটি টাকার বেশী।
নূর হোসেন দেওয়ানের চাচা আব্দুল করিম (মনাই দেওয়ান) একাধিক বার চেয়ারম্যান ছিলেন। নুর হোসেন দেওয়ানের ভাই ঈমাম হোসেন দেওয়ান ২বার ও তার চাচাতো ভাই আবুল বাশার দেওয়ান ২বার কেদারপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। বর্তমানে সেই পরিবারের সকলেই অসহায় ও ভূমিহীনদের কাতারে দাড়িয়েছে। জীবন বাঁচাতে আশ্রয় গ্রহন করেছেন সরকারি ভবনে, আত্মীয়ের বড়িতে ও ভাড়া করা বাসায়।
তিনি আরও জানায়, পানি উন্নয়ন বোর্ড হাসপাতালের ২শ মিটারের মধ্যে জিও ব্যাগ ফেলে হাসপাতাল রক্ষার চেষ্টা করছে। প্রথমে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড বর্তমানে তা ১০ কোটিতে বর্ধিত করা হয়েছে। হাসপাতালের নতুন ভবনের একটা অংশ নদীতে ভেঙ্গে পড়ায় জেলা প্রশাসন থেকে পাশবর্তী একটা ভবন বিক্রির টেন্ডার দেয়। টেন্ডার মূল্য ৩৫ হাজার টাকা আমরা সরকারকে দিয়ে দেই। অপরাপর ভবন টেন্ডার দিতে জেলা প্রশাসনকে বাঁধা প্রদান করেছি। যে ভবনের টেন্ডার মূল্য পরিশোধ করেছি সেই ভবন অক্ষত রয়েছে। যদি ভবনটি নদীতে ভেঙ্গে পড়ে তাহলেতো আর কিছুই করার নাই। ভবনটি রক্ষা পেলে সরকারের কাজেই ব্যবহার হবে। হাসপাতালের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রক্ষা হলে সরকারের সুবিধা ও আমাদের ঐতিহ্য রক্ষা হবে। আমাদের পরিচয় এখন হাসপাতালের অস্তিত্বের উপর অনেকটা নির্ভর করে। বসত বাড়ি ভেঙ্গে যাওয়ায় প্রথমে ক্লিনিকে উঠি। তখন আল্লাহর কাছে বলি ‘শেষ পর্যন্ত বউ-বাচ্চা নিয়ে বাজারে আনলা’। সেখানেও থাকতে পারিনি। ক্লিনিক চলে গেলে, সাথে স্টীল ফ্যাক্টরী, স্টীল দোকান, ফার্মেসী, কাপড়ের দোকানও নদী গর্ভে চলে গেল। এক সময় না খেয়েও কাটিয়েছি। এখন আত্মীয়-স্বজনরা রান্না করে দেয়। সেই খাবার খাই। এখনও বাজারের মাঝামাঝি দুটি ভিটি আছে সেখানে কিছু মালামাল রাখছি। তবে ব্যবসা শুরু করতে পারিনি। ক্লিনিক ভেঙ্গে পড়ার পর আমার ছেলে আল্লাহর উপর নাখোশ হয়। নামাজ ছেড়ে দেয়। ছেলেকে বলি আল্লাহ দিয়েছে সম্পত্তি আল্লাহই নিয়েছে। সাদ্দত সারা দুনিয়ার বাদশা ও সবচেয়ে বেশী ধন-সম্পত্তির মালিক ছিলেন। সে বেহেসত তৈরী করে। সেই বেহেসত নিয়ে এখন ৮টি বেহেশত। আল্লাহ চায়নি তাই নিজের তৈরী বেহেশতে সাদ্দত প্রবেশ করতে পারেনি। আল্লাহ সকল কিছু ভালোর জন্যই করেন। তার উপর নাখোশ হওয়া যাবে না।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রী এসে স্পীড বোটে চড়ে পদ্মার ভাঙ্গন কবলিত এলাকা পরিদর্শণ করেছে। পদ্মার পাড়ের মানুষ নদীর তীরে দাড়িয়ে ছিল। মন্ত্রী হাত তুলে তাদের থাপ্পর দেখিয়েছে। সুরেশ্বর গিয়ে মন্ত্রী বলেছে, পদ্মার পাড়ের চরাঞ্চল ভাঙ্গন কবলিত এলাকা। এখানে বন্যা, ঘূর্ণি ঝর হবে। এ এলাকার মানুষ পদ্মার সাথে সংগ্রাম করে বাঁচবে। এখানে বড় বড় বিল্ডিং করার দরকার কি ছিল। মন্ত্রীর ভাগ্য ভাল যে, “আমি সেখানে ছিলাম না। আমি থাকলে আমার জুতা প্রথম মন্ত্রীর গালে পড়ত”। ভাঙ্গন কবলিত মানুষের দুঃখ দূর্দশা দেখে মন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ না করে অসহায় মানুষের মনে আগুন জ্বালিয়ে গেছে। আমার এলাকাকে মন্ত্রী চরাঞ্চল বলেছে। আমরা তা মানি না। আমার দাদা ১০০ বছর বেঁচে ছিল। তার বাবাও ১০০ বছর বেঁচে ছিল। পদ্মার ভাঙ্গনের পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত আমরাও সেই বাড়িতে ছিলাম। এমনিতেই ৩০০ বছর পেড়িয়ে গেছে। আমাদের এলাকা কমবেশী ৪০০ বছরের পূরনো ছিল। আমরা চরের মানুষ না।
গত রোববার নড়িয়া উপজেলার পদ্মার ভাঙ্গন কবলিত এলাকা পরিদর্শণ করেছে পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের (ভারপ্রাপ্ত) সচিব কবির বিন আনোয়ার। রোববার সকাল ১১টা থেকে তিনি পদ্মার ভাঙ্গন কবলিত এলাকার মূলফৎগঞ্জ বাজার, নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, নড়িয়া পৌরসভার বাঁশতলা সহ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শণ করেন। পরিদর্শণ শেষে নড়িয়া উপজেলা অডিটোরিয়ামে ভাঙ্গন কবলিত মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন। এ সময় সাংবাদিকদের সাথে প্রেস ব্রিফিং করেন পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব কবির বিন আনোয়ার।
এ সময় সচিব বলেন, পদ্মা নদীর গতিপথ পরিবর্তনের জন্য নদীতে ড্রেজিং করা হবে। পদ্মা নদীর পানি কমতে শুরু করলে পদ্মার ডান তীর রক্ষা বাঁধের কাজ শুরু হবে বলে আশার আলো দেখিয়েছেন ভাঙ্গন কবলিত অসহায় মানুষদের। পরিদর্শণ শেষে অসহায় মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন সচিব। এ বাঁধ নির্মানের জন্য সরকার ইতোমধ্যে ১১শত কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে বলে এলাকাবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন সচিব।