আজ বুধবার, ৬ই ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ২১শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ২২শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

পদ্মার ভাঙনে বিলিন হয়েছে নড়িয়ার ১৫ বিদ্যালয়

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মোক্তারেরচর ইউনিয়নের একটি গ্রাম শেহের আলী মাদবরকান্দি। গ্রামটির পাশ দিয়ে কীর্তিনাশা নদী প্রবাহিত হয়েছে। কীর্তিনাশার পূর্ব তীরেই নড়িয়া উপজেলা সদর। আর ১০ কিলোমিটার দুরত্বে ছিল পদ্মা নদী। ১৯৭৬ সালে ওই গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। ১৯৯৩-১৯৯৪ অর্থ বছরে বিদ্যালয়ে একটি পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়। সেই ভবনে বসেই এলাকার শিশুরা মনের আনন্দে পড়ালেখা করত। ২০১৭ সালে পদ্মার ভাঙনে ভবনটি বিলিন হয়ে যায়। থমকে যায় শিশুদের পড়ালেখা। কিছুদিন বন্ধ থাকার পর পাশের এক ব্যক্তির উঠানে খোলা আকাশের নীচে শিশুদের পাঠদান কার্যক্রম চালু করেন শিক্ষকরা। উপজেলা প্রশাসনের সহয়তায় ওই গ্রামের সড়কের পাশে একটি টিনের ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়। এ বছর জুলাইতে তাও বিলীন হয়ে যায়। নিরুপায় শিক্ষকরা ওই ঘর খুলে কীর্তিনাশার তীরে একটি ফসলি জমিতে এনে রাখেন। সেখানে একটি ছাপড়ার ঘরে শিশুদের পাঠদান চালু করেন। এই সময়ের মধ্যে বিদ্যালয় ছেড়েছে ১২০ জন শিশু।
ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সামছুন্নাহার বলেন, যখন বিদ্যালয়টি পদ্মায় বিলীন হয় তখন শিক্ষার্থী ছিল ২০৫ জন। এখন আছে ৮৫ জন। দুই দফা ভাঙন, খোলা আকাশের নীচে পাঠ দান, রোদ, ঝর-বৃষ্টিতে কষ্ট এসব কারণে শিশুরা বিদ্যালয় ছেড়েছে। এখন যেখানে জমি ভাড়া নিয়েছি তাও নিচু। কাদা পানি থাকার কারণে শিশুদের কষ্ট হচ্ছে।
গত তিন বছরে শরীয়তপুরের নড়িয়া ও জাজিরা উপজেলার ১৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ২টি উচ্চ বিদ্যালয় নদী গর্ভে বিলিন হয়েছে। তিন বছরে কোন কোন বিদ্যালয় দুই-তিন দফা ভাঙনের শিকার হয়েছে।
ওই সব বিদ্যালয়গুলো এখন বিভিন্ন ফসলি জমিতে, ইউনিয়ন পরিষদে, মসজিদের বারান্দা, মাদরাসা ও মানুষের বাড়িতে পাঠদান কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
দফায় দফায় বিদ্যালয় পদ্মায় বিলিন, পুনরায় চালু করতে সমস্যা, খোলা আকাশের নীচে পাঠদান, গ্রাম থেকে দুরে কার্যক্রম চালু এসব কারণে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ অনেক পরিবার অর্থ কষ্টে শিশুদের পড়ালেখা বন্ধ করে দিচ্ছেন।
এ বছর পদ্মায় বিলীন হয়েছে পূর্বনড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চরজুজিরা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। পূর্বনড়িয়ার পাঠদান কার্যক্রম চলছে বাঁশতলা এলাকার দুলাল বেপারীর বসত বাড়ির একটি ঘরে। আর চরজুজিরার কার্যক্রম চলছে মুলফৎগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মুলফৎগঞ্জ মাদরাসার একটি কক্ষে।
নড়িয়ার ঈশ্বরকাঠি গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন মোস্তফা মাদবর। ২০১৬ সাল হতে ভাঙনে তার বসত বাড়ি ও আড়াই একর ফসলি জমি বিলীন হয়। নি:স্ব মোস্তফা আশ্রয় নেন তিন কিলোমিটার দুরের কালিকা প্রসাদ গ্রামে। তার দুই মেয়ে বিথী ও সাদিয়া ঈশ্বরকাঠি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী ছিল। ২০১৭ সালে বিদ্যালয় ভবনটি বিলিন হয়ে যায়। তখন থেকেই বন্ধ হয়ে যায় বিথী ও সাদিয়ার পড়ালেখা।
মোস্তফা মাদবর বলেন, মধ্যবিত্ত কৃষক ছিলাম। ফসলি জমির আয় দিয়ে সংসারের খরচ ও সন্তানদের পড়ালেখার খরচ চালাতাম। পদ্মায় সব গ্রাস করেছে। এখন নি:স্ব হয়ে মানুষের দাঁড়ে দাঁড়ে ঘুরছি। সংসার খরচ জোগাতেই হিমশিম খাচ্ছি, আবার সন্তানদের পড়ালেখার খরচ যোগাবো কিভাবে?
জাজিরার কুন্ডেরচ ইউনিয়নের কলমিরচর এলাকায় ছিল আলহাজ্ব ইসমাইল ম্যামোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়। ২০১৬ সালে বিদ্যালয়ের দুটি পাকা ভবন বিলীন হয়। তখন শিক্ষার্থী ছিল ৪৫৫ জন। এরপর পাশের একটি ফসলি মাঠে টিনের ঘর তুলে পাঠদান কার্যক্রম চালনো হয়, ২০১৭ সালে তাও বিলিন হয়ে যায়। গত ডিসেম্বরে পাশের সারেং কান্দি গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে টিনের ঘর তুলে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরে সেই স্থানও ছেরে দিতে হবে।
আলহাজ্ব ইসমাইল ম্যামোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক দীপক কুমার দত্ত বলেন, এখন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী আছে ২৪০ জন। গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে টিনের ঘর তুলে পাঠদান চালাচ্ছি। ডিসেম্বরে তাও ছেরে দিতে হবে। পাশের একটি ফসলি জমি ভাড়া নিয়েছি। সেখানে টিনের ঘর নির্মাণ করে পাঠদান কার্যক্রম চালানো হবে। বার বার ভাঙনের কবলে পরা ও স্থানচ্যুত হওয়ায় শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে।
শরীয়তপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ভাঙনে বিদ্যালয়গুলো বিলীন হওয়ায় ভবন নির্মাণের যায়গার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। আপাতত অস্থায়ী ভিত্তিতে টিনের ঘর নির্মাণ করতে প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ের জন্য তিন লাখ টাকা বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। খুব শিঘ্রই ওই টাকা পাওয়া যাবে। আর বিদ্যালয়গুলোর জায়গার ব্যবস্থা হলে স্থায়ী ভাবে ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হবে।