
তিনি ম্যাচ সেরা নন। সে পুরস্কারটা অনিবার্যভাবেই উঠেছে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের হাতে। খারাপ সময়কে পেছনে ফেলে অবশেষে আবার আলোয় রিয়াদ। প্রায় নিজেকে হারিয়ে ফেলা এ অভিজ্ঞ উইলোবাজ আজ ১৫১.২১ স্ট্রাইক রেটে উপহার দিয়েছেন ৪১ বলে ৬১ রানের ইনিংস।
যা প্রতিকূলতা আর বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে টাইগারদের পৌঁছে দিয়েছে প্রায় নিরাপদ অবস্থানে। তাই দিন শেষে মাহমুদউল্লাহর হাতেই শোভা পেয়েছে ম্যাচ সেরার পুরস্কার।
কিন্তু খেলা শেষে পঞ্চপাণ্ডবের অন্যতম বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য রিয়াদকে নিয়ে যত কথা, তার দ্বিগুনের বেশি আলোচেনা প্রথম বারের মত জাতীয় দলে চাঞ্জ পাওয়া শরীয়তপুরের আমিনুল ইসলাম বিপ্লবকে নিয়ে।
এটুকু পড়ে ভাববেন না আজ বাংলাদেশের অভিষেক হওয়া দুই তরুণের একজন আমিনুল ইসলাম বিপ্লব টিম বাংলাদেশের সেরা বোলার। তাও নয়। এ ম্যাচে তার ফিগার ৪ ওভারে ২/১৮। তার চেয়ে শ্রেয়তর ফিগার আছে আরও দুটি। প্রথমটি নিজ দলের পেসার শফিউল ইসলামের (৪ ওভারে ৩/৩৬)। অন্যটি জিম্বাবুইয়ান ফাস্টবোলার কাইল জারভিসের (৩/৩২)।
তারপরও দিন শেষে তাকে নিয়েই নানা কথা। রাজ্যের প্রশংসা-স্তূতি। সবার একটাই কথা- নির্বাচকদের ‘ক্রিকেট গ্যাম্বলটা’ শতভাগ ফলেছে। ব্যাটসম্যান কাম লেগ স্পিনার আমিনুল ইসলাম বিপ্লব আন্তর্জাতিক আবির্ভাবেই বাজিমাত করেছেন। লাল সবুজ জার্সি গায়ে যাত্রা শুরু করেই এ ২০ বছরের তরুণ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, আমি লেগ স্পিনটা ভালোই পারি। ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারলে আমাকে দিয়ে হবে।
পরিসংখ্যানকে নিয়ামক বা মানদণ্ড ধরলে জাতীয় দলের লাল সবুজ জার্সি গায়ে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতে আমিনুল ইসলাম বিপ্লবের চেয়ে ঢের ভালো বোলিং ফিগার আছে বাংলাদেশের বোলারদের। তাও একটি দুটি নয়। বেশ কটা।
জাতীয় দলের জার্সি গায়ে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে অভিষেকে বাংলাদেশের বোলারদের মধ্যে সেরা বোলিং ফিগারটি অনিবার্যভাবেই ইলিয়াস সানির। ২০১২ সালের ১৮ জুলাই বেলফাস্টে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে জাতীয় দলের হয়ে প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলতে নেমেই ১৩ রানে ৫ উইকেট দখল করে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন বাঁহাতি স্পিনার ইলিয়াস সানি।
টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশের আর কোনো বোলারের জাতীয় দলের অভিষেকে ৪ বা ৫ উইকেট না থাকলেও ওয়ানডেতে ওই কৃতিত্ব আছে চারজনের। ওয়ানডেতে অভিষেকে মোস্তাফিজ আর তাসকিনের ৫ উইকেট আছে। দুটিই ভারতের বিপক্ষে। মোস্তাফিজ ২০১৫ সালের ১৮ জুন শেরেবাংলায় ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচেই ৫ উইকেট পেয়েছিলেন ৫০ রানে।
আর ২০১৪ সালের ১৭ জুন শেরেবাংলায় তাসকিন ওই ভারতের বিপক্ষেই ২৮ রানে ৫ উইকেটের পতন ঘটিয়ে আগমনে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। এছাড়া অফস্পিনার সোহাগ গাজী এবং বাঁহাতি স্পিনার তাইজুলেরও ওয়ানডে অভিষেকে আছে ৪ উইকেট।
২০১২ সালের ৩০ নভেম্বর খুলনায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সোহাগ গাজীর অভিষেকে চার উইকেট (৪/২৯) আর, আর তাইজুলের আছে এই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষেকে (৪/১১, ১ ডিসেম্বর ২০১৪)।
আজ (বুধবার) রাতে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের শুরুতে সেই সব সোনালী সাফল্যকে স্লান করতে পারেননি আমিনুল ইসলাম বিপ্লব।
অংকের হিসাবে আর পরিসংখ্যানে তার অভিষেকে ১৮ রানে ২ উইকেট হয়তো আহামরি কোনো কৃতিত্বও নয়। কিন্তু অন্যভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করলে এই তরুণের এই বোলিং ফিগার ও ৪ ওভারের স্পেলটি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। অনেক আশা জাগানো।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশে বাঁহাতি স্পিনারের ছড়াছড়ি। সেই এনামুল হক মনি, মোহাম্মদ রফিক, আব্দুর রাজ্জাক, ইলিয়াস সানি, মাঞ্জারুল ইসলাম রানা, সাকিব আল হাসান, মোশাররফ রুবেল, আরাফাত সানি, তাইজুল ইসলাম, সাঞ্জামুল ইসলাম, নাজমুল অপু- কত নাম।
পাশাপাশি নাইমুর রহমান দুর্জয়, সোহাগ গাজী, মেহেদি হাসান মিরাজ, নাইম হাসানরাও বারবার সাফল্য বয়ে এনেছেন। কিন্তু বারবরই একজন লেগ স্পিনারের হাপিত্যেশ ছিল।
মাঝে তানভির হায়দার তারও আগে অলক কাপালি এবং প্রথম জীবনে মোহাম্মদ আশরাফুল মাঝে মধ্যে ঝলক দেখালেও একজন লেগ স্পিনারেরর অভাব ছিল সবসময়। আজকাল প্রায় তিন ফরম্যাটেই একজন করে লেগ স্পিনারের ছড়াছড়ি সব দলে; কিন্তু বাংলাদেশ একমাত্র দল ছিল, যে দলে তিন-চারজন স্পিনারের ছড়াছড়ি থাকলেও একজন লেগব্রেক গুগলি বোলার ছিল না।
অবশেষে আজ সেই লেগ স্পিনারের দেখা মিলল। শরীয়তপুরের ২০ বছর বয়সী আমিনুল ইসলাম বিপ্লব আবির্ভাবে আহামরি কিছু করতে না পারলেও দেখিয়ে দিয়েছেন, তার সামর্থ আছে ভালো জায়গায় বল করার। অযথা তেড়েফুড়ে বাড়তি কিছু করার চিন্তা ও চেষ্টা না করে যতটা সম্ভব লক্ষ্য ও নিশানা ঠিক রেখে এক জায়গায় বল ফেলার চেষ্টাও ছিল এ তরুণের।
সাধারণত লেগ স্পিনারদের যে বড় সমস্যা থাকে, বিপ্লবের মধ্যে আজ প্রথম ম্যাচে তা দেখা যায়নি। বেশির ভাগ লেগি এক ওভারে দু থেকে তিনটি ভালো ডেলিভারি দিয়ে হঠাৎ একটি ‘লং হফ’ বা খাটো লেন্থে বল করে বসেন। আর তাতেই মার খান। কিন্তু বিপ্লব তা করেননি। খাটো লেন্থে বল ফেলেননি বললেই চলে। লেগস্পিনের পাশাপাশি ফ্লিপার ও গুগলিও ছুড়েছেন।
দ্বিতীয় উইকেটটি পেয়েছেন ফ্লিপারে। সবচেয়ে বড় কথা অধিনায়ক আর নিজে মিলে যে ফিল্ডিং সাজিয়েছেন, সেই অনুযায়ী বল করে গেছেন। কখনই মনে হয়নি ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলছেন জাতীয় দলের হয়ে। বার দুয়েক মিস ফিল্ডিং না হলেও হয়তো ১৪/১৫ রানের বেশি উঠত না তার স্পেল থেকে। মোটকথা, যেমনটা চাওয়া ছিল, আজ শুরুতে তেমনটাই দেখা মিলল।
সমালোচকরা বারবার ব্যাটসম্যান বিপ্লবকে লেগি মানতে চাননি। চাইলেও সেভাবে মূল্যায়ন করেননি। বারবার বলেছেন আরে, বিপ্লবতো আগে ব্যাটসম্যান। পরে লেগব্রেক বোলার। সে কী করবে? দরকার ছিল একজন জেনুইন লেগির।
কিন্তু আমিনুল বিপ্লব দেখিয়ে দিলেন মূলত ব্যাটসম্যান হলেও আমার লেগস্পিনটাও মন্দ না। ভালোই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে লেগস্পিনার মানেই ‘উইকেট টেকিং বোলার।’ জুটি ভাঙার অস্ত্র। ব্রেক থ্রু উপহার দেয়ার হাতিয়ার।
খুব বাড়াবাড়ি হয়তো হবে না, বিপ্লবের মাঝে তা আছে। ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারলে আর এই শুরুর ভালো করাকে অনুপ্রেরণার প্রতীক ভেবে আগানোর চেষ্টা করলে ‘ব্যাটসম্যান ’ বিপ্লবই হয়তো একদিন নামি লেগস্পিনার হবেন।
কী বলেন আপনারা?