Saturday, 3rd June, 2023

সাবেক ডেপুটি স্পিকার কর্ণেল (অব:) শওকত আলী আর নেই

বর্ষিয়ান রাজনীতিক, সাবেক ডেপুটি স্পিকার ও শরীয়তপুর-২ আসনের ৬ বারের সাবেক সংসদ সদস্য কর্নেল (অবঃ) শওকত আলী আর নেই। সোমবার (১৬ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ৯টায় রাজধানীর সি এম এইচ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রজিউন। তিনি দীর্ঘদিন যাবত ডায়বেটিকস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনী, কার্ডিয়াক জটিলতা ও নিউমোনিয়ায় ভুগছিলেন।

 

তার ছেলে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ডা. খালেদ শওকত আলী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান আজ সোমবার বিকাল সাড়ে ৩টায় মরদেহ ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বসাধারনের শ্রদ্ধা নিবেদন এর জন্য রাখা হবে। বাদ মাগরিব বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। আগামীকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টায় হেলিকপ্টার যোগে মরদেহ নড়িয়ায় নেয়া হবে এবং সকাল ১১টায় নড়িয়া বি এল স্কুল মাঠে ২য় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে তাকে।

 

বর্ষিয়ান এ রাজনীতিবীদের মৃত্যুতে তাৎখনিক গভীর শোক প্রকাশ করেছেন শরীয়তপুর-২ আসনের বর্তমান সাংসদ পানি সম্পদ উপ-মন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম।

কর্নেল (অবঃ) শওকত আলী ১৯৩৭ সালের ২৭ জানুয়ারী শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার লোনসিং বাহের দীঘিরপাড় গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম মুন্সী মোবারক আলী এবং মাতার নাম মালেকা বেগম।

১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সনদপ্রাপ্ত হন এবং ১৯৭৮ সালে সুপ্রীমকোর্ট বার এসোসিয়েশনের সদস্যপদ লাভ করেন। এর আগে ২৪ জানুয়ারি ১৯৫৯ তারিখে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অর্ডন্যান্স কোরে কমিশন লাভ করেন। পেশাগত দক্ষতা বিবেচনা করে তাঁকে করাচির নিকটবর্তী মালির ক্যান্টনমেন্টে অর্ডন্যান্স স্কুলের প্রশিক্ষক নিয়োগ করা হয়।

তিনি রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য মামলার (যা আগরতলা মামলা নামে সমধিক পরিচিত) ২৬নং অভিযুক্ত ছিলেন। ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সশস্ত্র পন্থায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি অফিসার, সৈনিক, প্রাক্তন সৈনিক, বেসামরিক সরকারি কর্মকর্তা ও চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর সমন্বয়ে যে বিপ্লবী পরিষদ গঠিত হয়েছিল, কর্নেল শওকত আলী (তৎকালীন ক্যাপ্টেন) তার সদস্য ছিলেন। তিনি উক্ত মামলায় মালির ক্যান্টনমেন্ট থেকে ১০ জানুয়ারি ১৯৬৮ তারিখে গ্রেপ্তার হন। তিনি আগরতলা মামলার অভিযুক্ত হিসেবে ১৯৬৮-৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুর সাথে প্রায় ১৩ মাস কারাগারে ছিলেন। ১৯৬৯ সালে বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক গণ-বিস্ফোরণের মুখে পাকিস্তান সরকার মামলাটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু এবং কর্নেল শওকত আলীসহ অভিযুক্তগণ ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ তারিখে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বন্দীশালা থেকে মুক্তিলাভ করেন। এরপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে ১৯৬৯ সালে তাঁকে বাধ্যতামূলক অকাল অবসর দেয়া হয়।

তিনি ১৯৭১ সালে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। রণাঙ্গনে প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষায় হানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে রেখেছেন রীরত্বপূর্ণ অবদান। প্রথমে মাদারীপুর এলাকার কমান্ডার ছিলেন। পরে ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে সাব-সেক্টরের কমান্ডার তথা ফরিদপুর কোম্পানীর স্টুডেন্ট কোম্পানীর কমান্ডার এবং প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি মুজিবনগরস্থ সশস্ত্রবাহিনীর সদর দপ্তরের স্টাফ অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের শত্রুদের দ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর তাঁকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে পুণরায় অকাল অবসর দেয়া হয়। অবসরের সময় তিনি কর্ণেল পদে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে অর্ডন্যান্স সার্ভিসেসের পরিচালক (ডিওএস) ছিলেন।

অতপর তিনি ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক ছিলেন এবং দীর্ঘদিন এই সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন।

কর্নেল শওকত আলী ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে তিনি আওয়ামী লীগ সংসদীয় দল তথা বিরোধী দলের হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালের মে মাস থেকে ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১৬ মাস স্বৈরাচারী শাসক হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে কারাবরণ করেন।

১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং বেসরকারি সদস্যদের বিল এবং বেসরকারি সদস্যদের সিদ্ধান্ত প্রস্তাব সম্পর্কিত কমিটির সভাপতি এবং নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। এছাড়া ঐ সংসদে পিটিশন কমিটি, সরকারি হিসাব কমিটি এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।

২০০১ সালে অষ্টম সংসদে তিনি পুণরায় সদস্য নির্বাচিত হন, যেখানে তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এবং বেসরকারি সদস্যদের বিল এবং বেসরকারি সদস্যদের সিন্ধান্ত প্রস্তাব সম্পর্কিত কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নবম সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারী তিনি সর্বসস্মতিক্রমে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। তিনি ২২ মার্চ ২০১৩ হতে ৩০ এপ্রিল ২০১৩ পর্যন্ত জাতীয় সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনরায় সদস্য নির্বাচিত হন।

মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য আঞ্জু মোনোয়ারা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন কর্তৃক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত হন। দেশের প্রতি তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মাদার তেরেসা রিসার্চ কাউন্সিল কর্তৃক মাদার তেরেসা গোল্ডমেডেল লাভ করেন।

তিনি আগরতলা মামলার উপর বাংলায় “সত্য মামলা আগরতলা, ইংরেজীতে ‘আর্মড কোয়েস্ট ফর ইনডিপেন্ডেন্স’ এবং কারাজীবনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কারাগারের ডায়েরী’ শীর্ষক বইয়ের এর লেখক। ২০১২ সালে “বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রাম ও আমার কিছু কথা । ২০১৬ সালে “গণপরিষদ থেকে নবম সংসদ” শীরোনামে আরেকটি তথ্যবহূল বই রচনা করেন।